ভ্যাট বলতে আমরা বুঝি, ‘কোনো পণ্য বা পরিষেবার উৎপাদন ও বিতরণ শৃঙ্খলের প্রতিটি পর্যায়ে যুক্ত হওয়া মূল্যের ওপর কর।’ মাটি পোড়ানো, ইট উৎপাদন ও বিতরণের প্রতিটি পর্যায়ে যুক্ত হওয়া মূল্য বিশ্লেষণ করলে আমরা নিম্নরূপ তথ্য পাই :
Click Here for Media Coverage link
১. কৃষিজমির উর্বর মাটি সংগ্রহ: ইটভাটার মালিক অতি অল্প দামে কৃষিজমির ওপরের উর্বর মাটি কিনে থাকেন, যা কৃষক অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেন। এতে একদিকে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ কৃষিজমির উর্বর মাটির অযৌক্তিক ব্যবহারে খাদ্যনিরাপত্তা চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই পর্যায়ে মূল্য সংযোজন তো হচ্ছেই না বরং দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ করে বহুগুণে সামাজিক মূল্য হ্রাস প্রক্রিয়া ঘটানো হচ্ছে।
২. মাটি পোড়ানো: ক) জ্বালানির ব্যবহার—মাটি পোড়ানোর জন্য কাঠ, কয়লা বা গ্যাস ব্যবহূত হয়, যা বন উজাড় করে বা বৈদেশিক মুদ্রা খরচে আমদানিকৃত কয়লা বা মহামূল্যবান জাতীয় সম্পদ গ্যাসের অপব্যবহার করে থাকে। খ) পরিবেশ দূষণ : কাঠ বা কয়লা পোড়ানোর ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনঘাতী পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অধিকন্তু, ইটভাটার আশপাশের জনজীবন ও কৃষিসহ বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। পরিবেশদূষণে প্রতি বছর ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুবরণ ও যাবতীয় কৃষিজাত দ্রব্যের ফলন বিঘ্নিত করতে ইটের ভাটার নিঃসারিত কার্বনই অন্যতম কারণ।
৩. পরিবহন ও বিতরণ: কাঁচামাল হিসেবে মাটি সংগ্রহ ও ইট বিতরণে ভারী যানবাহন ব্যবহূত হয়। সেই যানবাহন একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করে, অন্যদিকে মানুষের চলাচলের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত করে জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। ফলে রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত খরচ বাড়ে এবং রাস্তায় দুর্ঘটনা, যানজট, পরিবেশদূষণ ও যাতায়াত খরচ বাড়ায়। অধিকন্তু, বিকল্প নির্মাণসামগ্রীর তুলনায় ইট অতিরিক্ত ভারী হওয়ায় এর ব্যবহারে ভবনের ওজন বৃদ্ধি পায় ও খরচ বাড়ে এবং ভূমিকম্পে ভবনের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওপরের তথ্যাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মাটি পোড়ানো ইট উৎপাদনের সব স্তরে কোনোরূপ মূল্য সংযোজন তো হচ্ছেই না বরং অবিশ্বাস্য সামাজিক মূল্য বিয়োজন হচ্ছে। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ (এইচবিআরসি)’ মনে করে, ইটের ওপর কোনো ভ্যাট না বসিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা কর, পরিবেশ কর, বনায়ন কর ও রাস্তা কর ধার্য করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
অনুরূপভাবে কৃষিজমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণের ফলে আমরা প্রতিনিয়ত অতি মূল্যবান সম্পদ কৃষিজমি হারাচ্ছি। আবাসন মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার, কিন্তু কৃষিজমি নষ্ট করে তার ওপর বাড়ি বানানো খাদ্যনিরাপত্তার ওপর মারাত্মক হুমকি। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর আমরা শতকরা ১ ভাগ কৃষিজমি হারাচ্ছি, যার শতকরা ৮০ ভাগ কৃষিজমিতে বাড়ি করার কারণে এবং ১৭ দশমিক ৪ ভাগ ইটের কাঁচামাল ও ইটের ভাটার কারণে। ইট পোড়ানোর প্রক্রিয়ায় পরিবেশদূষণকারী কণা পদার্থ ও গ্যাস নির্গত হয়, যা বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও শ্বাসযন্ত্রে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। উপরন্তু, ইটের ভাটাগুলো জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা কয়লার ওপর নির্ভর করে, যা বন উজাড় ও পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী।
এই উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করতে এবং টেকসই অনুশীলনগুলো উৎসাহিত করতে আমি দৃঢ়ভাবে কৃষিজমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ ও ইটের ওপর একটি নির্দিষ্ট কর আরোপের আহ্বান জানাই। মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) পরিবর্তে এই ধরনের ট্যাক্স উন্নয়ন ও উত্পাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত দিকগুলোকে বিবেচনায় রাখতে, বিকল্প নির্মাণ উপকরণ গ্রহণকে উদ্দীপিত করতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার জন্য রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।
এই নির্দিষ্ট ট্যাক্স থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, টেকসই নির্মাণ অনুশীলন যেমন পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রীর গবেষণা ও উন্নয়ন, পেশাদার ও সাধারণ জনগণের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অনুশীলনকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বরাদ্দ হতে পারে। উপরন্তু, সাশ্রয়ী মূল্যে দ্বিতল বাড়ি, ইটের বিকল্প উদ্ভাবন ও উৎপাদন, বনায়ন ও টেকসই কৃষি অনুশীলনের প্রচার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য তহবিল বরাদ্দ করা যেতে পারে।
কৃষিজমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ এবং মাটি পোড়ানো ইটের ওপর একটি নির্দিষ্ট কর আরোপ কৃষিজমি সংরক্ষণ, টেকসই নির্মাণ অনুশীলন, কৃষিজমির উর্বরতা সংরক্ষণ, বায়ুদূষণ হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব প্রশমন এবং নির্মাণশিল্পে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ ও সমাজের ওপর ইতিবাচক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরি করার সম্ভাবনার কারণে আমি বিষয়টিকে বাজেট চূড়ান্তকরণ পর্যায়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ ও সমর্থনের অনুরোধ করছি। সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজন হতে পারে এমন আরো কোনো তথ্য বা ব্যাখ্যার জন্য যে কোনো সহায়তা প্রদানে আমরা কৃতার্থ হব। আমরা টেকসই উন্নয়ন ও ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিশ্রুতি এবং জাতির জন্য একটি সবুজ ভবিষ্যতের জন্য সবার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করি।
লেখক:
মোহাম্মদ আবু সাদেক, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ (এইচবিআরসি), ঢাকা।